ঈমান কী, মুমেন ও মুসলমান কাকে বলে?
সরল উত্তর: ঈমান আরবী শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বিশ্বাস।কোন কিছুর উপর মনে-প্রাণে, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান।ইসলামের পরিভাষায় সর্বশক্তিমান আল্লাহু তা’য়ালাকে তাঁর সমস্ত পরিচয় ও নির্দেশাবলি সহ তাঁর বাণী মোতাবেক অর্থাৎ পবিত্র কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী পরিপূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করাকে ঈমান বলা হয়। আর এভাবে যে বা যারা বিশ্বাস করবে তাকে বা তাদেরকে ঈমানদার বা মুমেন বলা হয়।আবার এ বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে হবে মানুষ ও মহান আল্লাহু তা’লার নিকট মৌখিক ভাবে প্রকাশ্যে এবং আন্তরিক বিশ্বাস ও কাজে পরিণত করার মাধ্যমে। এর একটিতেও ঘাটতি থাকলে তাকে মুমেন বা মুসলিম বলা যাবে না । তার মানে একজন মুমেনকে তার ঈমানের বিষয়টি মুখে স্বীকার করতে হবে, অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে ও কাজে পরিণত করে জনসমাজে এর প্রমাণ দিতে হবে। এ জন্যেই যে বাক্যে, কর্মে ও চিন্তায় সৎ নয়, সে প্রকৃত প্রস্তাবে সৎ নয় এবং মুখে ও কাজে যে এক নয় সে খাঁটি মুমেন নয়। আর এ জন্যেই নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপর ভায়ের জন্য যদি তা পছন্দ না করে অথবা পাশেই তার প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে নিজে তৃপ্তি মোতাবেক জীবন-যাপন করে অথবা মুসলমানদের দু:খ-দূর্দশা দেখে যার একটুও কষ্ট অনুভূত হয় না ও সাধ্য অনুযায়ী তা নিরসনে সচেষ্ট হয় না, তবে এ সূরতের ব্যক্তিগণ আসলে প্রকৃত মুমেন নয়। কারণ ইসলামে এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই এবং তারা অবশ্যই পরষ্পর পরষ্পরের আয়না স্বরুপ। এছাড়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য যে জান, মাল, সন্তান-সন্ততি এবং তার সমস্ত অর্থ-সম্পদ সহ তার সকল কিছু খুশি মনে উৎসর্গ করতে না পারবে, তবে সেও কখনোই প্রকৃত মুমেন হতে পারবে না। অতএব, এ ধরনের বিশ্বাস ও কর্মের সাথে সাথে যে বা যারা, তা নিজের জীবনে মেনে চলার অঙ্গীকার দেয় ও সে মতে নিজের জীবনকে পরিচালনা করার চেষ্টা করে তবে তাদের প্রত্যেককে মুমেন বলা হয়। সকলকে স্পষ্ট করে মনে রাখতে হবে যে, মুমেন হওয়া বা মুসলমান হওয়া এটা কোন বংশীয় সূত্র নয়। বরং মুসলিম ঘরে বা বংশে জন্ম গ্রহণ করেও যদি তার উপরোক্ত এ বিশ্বাস ও নীতি না থাকে, তবে সে কিছুতেই মুমেন বা মুসলমান হতে পারে না। হয়তো মুসলিম সম্প্রদায় ভূক্ত হিসেবে তিনি সমাজের কাছে পরিচিত হতে পারেন, আসলে তিনি মুমেন বা মুসলিম নয়। অর্থাৎ মুসলিম হতে হলে একজন মানুষকে ( হোক সে মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণকৃত অথবা নওমুসলিম) কালিমা পাঠের সাথে সাথে পবিত্র কোরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীস শরীফকে পুরোপুরি মেনে নিতে হবে। এভাবে অনেক গুলো মুমেনের পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক , রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী মেনে নিলে ও তদঅনুযায়ী আমল করার জন্য চেষ্টা করতে থাকলে তবে এ ধরনের প্রত্যেক মুমেনকে মুসলমান বলা হয়। মহান আল্লাহু তা’য়ালার প্রিয়পাত্র হতে হলে একজন মুমেনকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। অর্থাৎ তাকে শুধু ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সহ সামগ্রীক ভাবে একটি মনুষ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের সকল দিক সম্মানের সহিত মেনে চলতে হবে। (তবে আলেমুল গায়েব মহান আল্লাহু তা’য়ালা। কেয়ামতের মাঠে এ ধরনের যদি কোন মজলুমকে মাফ করেন, অর্থাৎ যিনি মজলুম হওয়ার কারণে বা যে কারণেই হোক, তার ঈমানের বিষয়টি জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে পারেন নি; তাহলে তা হবে মহান রবের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। সাবধান দুনিয়াতে এ ধরনের কাউকে মুমেন বা মুসলিম বলা যাবে না। যেহেতু তিনি এ ধরনের ব্যক্তিকে মাফ করবেন কিনা বা তার ঈমান কবূল করবেন কিনা এ যাতীয় কোন কথা পবিত্র কুরআন-হাদীসের কোথাও স্পষ্ট করে মহান রব বলেন নাই) । একজন অমুসলিমকে মুসলমান হতে হলে তাকে অবশ্যই পবিত্র কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ পুরোপুরি মেনে চলার অঙ্গিকার সহ কালিমায়ে তায়্যিবাহ ও কালিমায়ে শাহাদাত অপর মুসলমানের সামনে শব্দ করে অর্থ বুঝে ও অর্থ বুঝার সুবিধার্থে অর্থ সহ মৌখিক ভাবে পড়তে হবে। যাতে মনুষ্য সমাজ জানতে পারে যে, তিনি মুসলমান। আবার এ অবস্থায় মানুষের মাঝে মুসলিম পরিচয়ে তাকে টিকেও থাকতে হবে। মানুষ জানতে পারা ও টিকে থাকা, অর্থাৎ ঈমান না হারানো; এ জন্যে ঐ নওমুসলিম ভাইটির প্রয়োজন হবে, ইসলামি জ্ঞান অর্জন এবং তদঅনুযায়ী আমল ও দেশীয় আইন অনুযায়ী এফিডেভিট এবং সরকারী রেজিস্ট্রেশন। অপরদিকে মুসলিম পিতা-মাতার পরিবারে জন্মগ্রহণকারীদের জন্য এভাবে কারো সামনে প্রকাশ্যে কালিমা পড়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ মানুষতো এমনিতেই জানে এবং সেও পরিচয় দেয় যে, সে মুসলমান। তবে মূল কথা হচ্ছে ঈমান বা বিশ্বাস এটি মানুষের মনের ব্যাপার। তাই যতক্ষণনা একজন মানুষ নামাজ কায়েমের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাতায়াত করবেনা বা নামাজ কায়েমের প্রচেষ্টা চালাবে না ততক্ষণ তার ঈমানের বাহ্যিক সাক্ষ্য আমরা দিতে পারি না। আর কোন মানুষের ঈমানের আভ্যন্তরিন সাক্ষ্য অর্থাৎ ঈমানের প্রকৃত বা গেরান্টেড সাক্ষ্য অন্য কোন মানুষ বা জ্বীন জাতিদের মধ্য হতেও কেউ, তার মানে অন্য কোন মানুষ বা জ্বীন কেউই দিতে পারে না এবং দেয়া সম্ভবও নয়। যেহেতু প্রত্যেক মানুষ ও জ্বীনের মনের খবর শুধুমাত্র মহান আল্লাহু তা’য়ালাই জানেন; দ্বিতীয় আর কেউই জানে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ঈমান থাকে তার দিলের বা আত্মার অনেক গহীনে। তাই অমুসলিম সহ যে কোন মানুষকে বেঈমান বলে তিরস্কার করতে বা ভৎসনা করতে বা অপমাণ করতে, আপনি পারবেন না। কারণ হতে পারে আজকে যাকে আপনার কাছে বেঈমান বা মন্দ লোক বলে মনে হচ্ছে, হয়তো তার ভিতরকার ঈমান আপনার আর আমার চাইতে ভালো, যার ক্রিয়ায় শেষ বয়সে সে হয়ত আমাদের চাইতে আরো ভালো ও নির্ভেজাল ঈমান নিয়ে ইন্তেকাল করবে, যা হয়তো আমাদের ভাগ্যে জুটবে না। এখানে আমাদেরকে খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, মানুষের ঈমানের বিচার যেমন লোকটি মুসলিম ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছে কিনা, সে হিসেবের মাধ্যমে সম্ভব নয়; ঠিক তেমনি মানুষের বে-ঈমানদারীর বিচারও লোকটি অমুসলিম ঘরে জন্মেছে কিনা, সে হিসাবের দ্বারা সম্ভব নয়। হতে পারে তার বে-ঈমানদারীর বা পাপের জন্য ইতোমধ্যে সে তাওবা করেছে, যা আপনি জানেন না। আর এরই মধ্যে সেই পাপের জন্য আপনি তাকে অপমাণ করলেন; তাহলে মনে রাখবেন, হয়তো এমনও হতে পারে যে, আপনি তাকে যে পাপের জন্য অপমাণ করেছেন, জীবনের কোন না কোন সময়ে আপনিই সে পাপে নিমজ্জিত হয়ে গেছেন। আপনি কি আপনার জীবনে দেখেননি (?), প্রথম জীবনে অনেক গুলো মানুষ খুবই ভালো ঈমানদার ও আমল ওয়ালা ছিলো, কিন্তু শেষ বয়সে তারাই বদআমলদার হয়ে গেলো বা মন্দ লোকে পরিণত হয়ে গেলো। অপরদিকে এর বিপরীত সিস্টেমটিও অর্থাৎ প্রথম জীবনে বেঈমান বা মন্দ লোক ছিলো, কিন্তু শেষ বয়সে ঈমান আনয়ন করলো বা ভালো লোকে পরিণত হলো। মনে রাখুন, মানুষের শেষ আমলই গ্রহণযোগ্য। তাই সমাজে ভালো ঈমানদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে কাউকে বেঈমান বা মন্দ লোক মনে করে খারাপ ব্যবহার করা, ইহা কোন মুমেনের পরিচায়ক নয়। মুমেনের সবচেয়ে বড় পরিচয় এটিই যে, তার চরিত্র বা আখলাক বা মানুষের সাথে তার ব্যবহার সবচাইতে ভালো হবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা:) মানুষের সাথে এমন ভাবে ব্যবহার করতেন যে, যেন নবীজির (সা:) সাথে ব্যবহার রত মানুষটি মনে করতো নবীজি (সা:) মনেহয় সবার চাইতে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। মূলত: মন্দ লোকের সাথে উত্তম ব্যবহার এটিই মুমিনের ছিফত। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, তাই একজন মুমেন মুসলিম-অমুসলিম সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে, এটিই হবে একজন মুমেনের সর্বোত্তম গুণ। সকল মুসলমানকে খুব ভালো করে খেয়াল রাখা উচিৎ, কেয়ামতের মাঠে বান্দার যে আমলটি সবচাইতে ভারী হবে, তা হচ্ছে তার উত্তম আখলাক। অর্থাৎ মানুষের সাথে তার বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার। অহিংস, নিষ্কলঙ্ক, ধর্জ ও সহ্যের সীমা, ক্ষমার মানষিকতা, মানুষের প্রতি দয়া-মায়া ও উদারতা, আর অহংকারহীন সরল-সহজ জীবন ব্যবস্থাই পরিচয় করিয়ে দিবে মানুষটির ঈমান কিরুপ বা ঈমানের দৃঢ়তা কতটুকু। আবার লক্ষ্য করেন, একজন মুমেনের দ্বারা কখনো অন্য কোন মানুষের, এমনকি অন্য কোন প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে না। অর্থাৎ তার ভাষায়, ব্যবহারে, দৃষ্টিভঙ্গিতে বা তার কোন কার্জ কলাপে অন্য কেহ কষ্ট পাবে না, মানুষের কোন হক বা আমানত তিনি নষ্ট করবেন না, মানুষের কোন বিশ্বাস তিনি ভঙ্গ করবেন না। মানুষেরা তাকে তাদের জান ও মালের বিষয়ে ভয় করবে না, বরং বিশ্বস্থ ও নিরাপদ মনে করবে। আরো বিশ্লেষণ করে বললে বলতে হয়, একটি মুসলিম দেশে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অমুসলিম দেশেও প্রকৃত মুমেন মানুষদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ, রেব, থানা, আদালত এসবের তেমন প্রয়োজন হবে না। কারণ মুমেন, তিনি মহান আল্লাহু তা’য়ালাকে ভয় পান। তার রবের ভয়েই তিনি কোন অপরাধ করতে পারেন না। মুমেন সাধারণত তার যে কোন কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে, সরল-সহজ ও সিম্পল জীবন-যাপন করবে। সে কখনো মিথ্যা বলবে না, মিথ্যার আশ্রয় নিবে না, সত্যকে মিথ্যার সহিত মিশ্রিত করবে না ও জেনে-বুঝে সত্য গোপন করবে না। এ ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিদেরকেই ঈমানদার বা মুমেন বলা হবে। অন্যদিকে ঈমানের রয়েছে সাতাত্তরটি শাখা-প্রশাখা। যার প্রত্যেকটিতে একজন মুসলমানকে পরিপূর্ণ আমল না করলে তিনি কিছুতেই প্রকৃত মুসলমান হতে পারবেন না। তাই পরবর্তী প্রবন্ধ ও ভিডিও সমূহের মধ্যে সে বিষয়ে অর্থাৎ ঈমানের সবগুলো শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হবে ইনশা’আল্লাহু তা’য়ালা। সে পh©ন্ত সকলকে সাথে থাকার আহবান জানিয়ে আজকের মতো এখানেই শেষ করলাম। আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
0 Comments